জামাত শিবির এবং গণতন্ত্র
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্দোলনে শিবিরের ভূমিকা নিয়ে বেশ কিছু বিতর্ক দেখা দেয়। বিতর্কটা মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে কার কি ভূমিকা তা নিয়ে এবং এই ভূমিকার যথার্থতা নিয়ে। কিন্তু জামাত শিবির কতটা গনত্রন্ত্র এ বিশ্বাস করে এবং তাদের দ্বারা আমরা একটি গণত্রান্ত্রিক দেশ ঘটনার দিকে আমরা যেতে পারবো কিনা তা নিয়ে নয়। এই বিষয়টা নিয়ে আমার কিছু কথা আছে।
প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে জামাত এবং এর ছাত্র সংগঠন শিবির আদর্শিকভাবে গনত্রন্ত্রে বিশ্বাস করে কিনা। যদি বিশ্বাস করে তবে তাদের গনত্রন্ত্র কেমন।
(তর্কের খাতিরে আমরা জামাত এবং শিবিরের ১৯৭১ এর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করবো না। এবং আদর্শিক ছাড়া তাদের বর্তমান কোন বিষয় নিয়ে আমি এই পোস্ট এ কথা বলবো না।)
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আমরা জামাত এবং শিবিরের আদর্শিক গুরু মওদূদী এবং গোলাম আজমের চিন্তা ভাবনা দেখতে পারি।
গণতন্ত্র সম্পর্কে মওদূদী বলেন (মাওলানা মওদুদী, ইসলাম ও ধর্মহীন গণতন্ত্র, পৃ: ২৬) –
আমি মুসলমান ভাই-ভগ্নিদেরকে পরিষ্কাররূপে বলে দিতে চাই যে, বর্তমান যুগের ধর্মহীন গণতন্ত্র সম্পূর্ণরূপে আপনাদের দ্বীন ও ইমানের পরিপন্থী জিনিস। উনার সম্মুখে আপনাদের মাথা অবনত করে দেয়ার অর্থ কুরআন হতে মুখ ফিরিয়ে থাকা। আপনারা যদি উহার প্রতিষ্ঠা ও স্থায়িত্বের কাজে অংশগ্রহণ করেন, তবে উহা হবে আপনাদের রাসূল সা এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর। আর যদি আপনারা উহার পতাকা উড্ডীন করতে দণ্ডায়মান হয়, তবে উহা হবে আপনার আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহীর পতাকা উত্তোলনের শামিল।
এবার দেখা যাক গোলাম আজম এর ভাবাদর্শ। মওদূদী যতটা কঠোরভাবে গণতন্ত্রকে ইসলামের বিপরীতে দাঁড় করিয়েছেন, গোলাম আজম ততটা কঠোর হয়নি গণতন্ত্রের বিষয়ে।
গোলাম আজমের মতে, ইসলামের সাথে গণতন্ত্রের তেমন কোনো বিরোধ নেই। তবে একটা পার্থক্য রয়েছে। তাঁর ভাষায় –
প্রচলিত গণতন্ত্র পাশ্চাত্য থেকেই আমদানি হয়েছে। ঐ গণতন্ত্রে জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত। সার্বভৌমত্ব মানে আইন রচনার সর্বোচ্চ শক্তি। আইনের সর্বজনীন সংজ্ঞা হলো “Law is the will of the sovereign” (সার্বভৌম সত্তার ইচ্ছাই আইন)। আধুনিক গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় জনগণই সার্বভৌম সত্তা।
(গোলাম আজম, ইসলাম ও গণতন্ত্র, পৃ ৫)
“প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ও পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ইসলামে সার্বভৌমত্ব আল্লাহর, আর পাশ্চাত্য গণতন্ত্রে জনগণই সার্বভৌমত্বের অধিকার।”
(গোলাম আজম, ইসলাম ও গণতন্ত্র, পৃ ৬)
“ইসলামকে বিজয়ী আদর্শ হিসাবে কায়েম করার উদ্দেশ্যে যারা ইকামাতে দ্বীনের আন্দোলনে সক্রিয় তাদের মধ্যে কেউ কেউ গণতন্ত্রকে কুফরি মতবাদ বলে প্রচার করেন। এ কথা অবশ্যই সত্য যে জনগণের সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে যে গণতন্ত্র চালু আছে তা নিঃসন্দেহে কুফরি।”
(গোলাম আজম, ইসলাম ও গণতন্ত্র, পৃ ১০)
গোলাম আজমের মতে, যে গণতন্ত্রে বলা হয়, জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, সে গণতন্ত্র কুফরি। এ ছাড়া গণতন্ত্রের সাথে ইসলামের কোনো পার্থক্য নেই।
যেকোন গনত্রান্তিক রাষ্ট্রের একটা বড় দিক হলো সংখ্যালঘুদের অধিকার। এর বিষয়ে মওদূদী এবং গোলাম আজম এর চিন্তা কাছাকাছি। মওদূদী ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার নিয়ে মওদূদী বক্তব্য হলো (বই - ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার) অমুসলিমরা রাষ্ট্রের কোন প্রকার পদে থাকতে পারবেন না এবং নিরাপত্তা বাহিনীতে তারা চাকরি করতে পারবেন না। রাষ্ট্রে তাদের জীবন হবে মুসলমাদের অধীন। সবচেয়ে বড় কথা অমুলসিমদের রাজনৈতিক অধিকার থাকবে খুবই সীমিত এবং ভোটাধিকার থাকবে না।
গোলাম আজমের এই বিষয়ে বই হলো - অমুসলিম নাগরিক ও জামায়তে ইসলামী এবং ধর্ম-নিরপেক্ষবাদ ও জামায়াতে ইসলামী। এই বইগুলো আমাদের কি বলে?
ধর্মনিরপেক্ষবাদের সংজ্ঞ সবাই এক রকম দেয় না। এর অর্থ যদি এটা হয় ষে ধর্মের ব্যাপারে কোন পক্ষপাতিত করা চলবেনা এবং সব ধর্মকে স্বাধীনভাবে পালন করার সমান স্থযোগ দিতে হবে তাহলে জামায়াতে ইসলামী এ কথা সমর্থন করে। কিন্তু কেউ যদি ধর্ম-নিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে বলেন যে “ধর্স শুধু ব্যক্তিগত জীবনেই সীমাবদ্ধ থাকবে, সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে ধর্সের কোন সম্পর্কই থাকবে না” তাহলে এট! অবাস্তব কথা । যেব্যক্তি সত্যিকার ধামিক তাকে শুধু ব্যক্তি জীবনেই নয়–জীবনের সব ক্ষেত্রেই ধামিক হতে হবে। বিশেষ করে ইসলাম মানুষের বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন কোন ধর্ম নয়।
( ধর্ম-নিরপেক্ষবাদ ও জামায়াতে ইসলামী, পৃষ্ঠা ২১)
এ দেশের হিন্দুঃ বৌদ্ধ ও খ্রীষ্টান ভাইদের নিকট জামায়াতে ইসলামী এ কথাটা গভিরভাবে চিস্তা করার জন্ত আহ্বান জানাচ্ছে যে তারা ইসলামের চেয়ে সমাজতন্ত্রকে কেন বেশী পছন্দ করবেন? গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন ও সরকার গঠনের বেলায় তাদের সাথে জামায়াতের কোন মৌলিক পার্থক্য নেই। তাহলে সমাজতন্ত্রের জায়গায় ইসলামকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গ্রহণ করতে আপত্তি হবার কোন যুক্তি থাকতে পারে না।
ধর্মীয় ব্যাপারে হিন্দু থেকেও রাষ্ট্রীয় মতাদর্শ হিসেবে ইসলামকে স্বীকার করতে কোন বাধা নেই।
একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে এদেশে ইসলামী আদর্শের প্রতিষ্ঠা ছাড়া সমাজতন্ত্র থেকে বাচার কোন উপায় নেই। আর জ্ঞানী লোকেরা স্বীকার করতে বাধ্য যে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র এক সাথে চলতে পারে না । সমাজভন্ত্র শুধু রাজনৈতিক :মতবাদ নয় এটা একটা পূর্ণাংগ সমাজ দর্শন। আর গণতন্ত্র গুধু সরকার গঠনের একটি পদ্ধতি মাত্র। আদর্শ ও মতবাদ হিসেবে সমাজতন্ত্র অত্যন্ত ব্যাপক। তাই গণতন্ত্রের সাথে এর রাজনৈতিক পদ্ধতিতে পার্থক্য থাকলেও সমাজতন্ত্রের “বিকল্প মতবাদ হিসেবে গণতন্ত্র যথেষ্ট নয়। প্রশ্ন জাগে যে যারা সংগত কারণেই সমাজতন্ত্র পছন্দ করেন না তাদের নিকট বিকল্প মতাদর্শ আর কি আছে? এখানেই ইসলামের আবির্ভাব । সমাজতন্ত্র থেকে আত্মরক্ষা করতে হলে শুধু গণতান্ত্রিক অস্ত্রই যথেষ্ট নয়। একমাত্র ইপলামের মতো পূর্ণাংগ জীবন বিধান ও সমাজ-দর্শনই বিকল্প মতাদর্শ হিসেবে সমাজতন্ত্রকে উৎখাত করতে সক্ষম ।
(অমুসলিম নাগরিক ও জামায়তে ইসলামী - গোলাম আজম, পৃষ্ঠা ২০)
হিন্দুদের সম্পর্কে জনগণের মধ্যে এ ধারণা ছিলনা । কারণ পৃথক নির্বাচনের কারণে রাজনৈতিক ময়দানে হিন্দুদের সাথে জনগণের কোন সংঘর্ষ বা মতবিরোধ ছিলনা । কিন্তু যুক্ত-নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনের বেলায় মুনলমানদের সাথে তাদের বিরোধ স্থষ্টি হয়। মুসলমানরা লক্ষ্য করে যে হিন্দু ভোটারদের জোরে মুসলিম নামধারী এমন প্রার্থী বিজয়ী হয়ে যায় যে চিন্তা ও চযিত্রে মুসলিম বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অন্তভূক্তি নয়। এর ফলে মুসলিম চেতনা সম্পন্ন সবাই হিন্দু ভোটারদেরকে সংখ্যাগরিষ্ঠদের বিরোধী বলে মনে করতে বাধ্য হয়।
১৯৭৭ সাল থেকে ৮২ সাল পর্যস্ত যে কট! নির্বাচন হয়েছে তাতে দেখা যায় যে এ দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটাররা আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেনি। যে কারণেই হোক বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠী ভারতকে এদেশের নিঃস্বার্থ বন্ধু মনে করে না। অথচ তারা আওয়ামী লীগকে ভারতের বন্ধু মনে করে এবং হিন্দুদেরকে আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে ধারণা করে। পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা থাকলে এ জাতীয় ধারণা সৃষ্টির কোন পরিবেশই থাকতো না। তাই হিন্দু ভোটে হিন্দু প্রতিনিধি এবং মুসলিম ভোটে মুসলিম প্রতিনিধি নির্বাচনের বিধান ছাড়া হিন্দুদের রাজনৈতিক মর্যাদা বহাল করার কোন উপায়ই দেখা যাচ্ছে না।
(অমুসলিম নাগরিক ও জামায়তে ইসলামী - গোলাম আজম, পৃষ্ঠা ১৬)
উপরের আলোচনা থেকে এই কথা স্পষ্ট করে বলা যায় যে জামাত শিবির আদর্শিকভাবে একটি উন্মুক্ত গনত্রন্ত্রে বিশ্বাস করে না যেখানে রাষ্ট্রের সকল নাগরিক সমান এবং সমান অধিকার ভোগ করবে। বিশেষত অমুলসিমদের অধিকার হবে খুবই সীমিত এবং কার্যত তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হবে।
যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে শিবির এর উলেখযোগ্য ভূমিকা ছিলো, তাহলে প্রশ্ন হলো এই শিবির কে দিয়ে আপনি গনত্রন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন কিনা, যে গনত্রন্ত্রের জন্য আমরা এতো রক্ত দিলাম। বিশেষত সেই গণতন্ত্র যেখানে রাষ্ট্রের সব মানুষ - ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই সমান।