Fakir Shah

গুমের বিচার বাংলাদেশ করতে পারবে না

যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এর একটা কথা অনেক মনে পরে।  

যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ন্যূনতম যে দক্ষতা ও নিবেদিতপ্রাণ প্রসিকিউটরের প্রয়োজন ছিল, তার বড়ই অভাব ছিল। যুদ্ধাপরাধ ট্রায়ালের জন্য যাদের সরকারি কৌঁসুলি নিয়োগ করা হয়েছিল তাদের শীর্ষস্থানীয় একজন যখন আমাকে বললেন, ‘আমার …কে আমাকে বাঁচাতে হবে’, তখন আমার মনে হয়েছিল যুদ্ধাপরাধের আর বিচার হচ্ছে না। আমি আমিনুল হককে (পরে তিনি অ্যাটর্নি জেনারেল হন) বলেছিলাম, ‘আপনারা ওঅর ক্রাইমের ট্রায়াল করতে পারবেন না।’

গুম নিয়ে সরকার, কমিশন এবং সামরিক এবং অনন্যা বাহিনীর কার্যক্রম দেখে আমিও বাংলাদেশ কে বলতে চাই ‘গুমের বিচার আপনারা করতে পারবেন না।’ 

যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে শুরু করছিলাম। তার। গুম যুদ্ধাপরাধের মতো না হলেও এর ব্যাপকতা বিশাল। এইটা পুরো সমাজের সাথে একটা অপরাধ। যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে গেলে যেমন রাষ্ট্রের যেমন সদিচ্ছা লাগে, তেমনি, গুমের বিচার করতে গেলেও রাষ্ট্রের সদিচ্ছা ভয়ঙ্কর গুতুত্বপূর্ণ। যুদ্ধাপরাধের বিচার করার মতোই গুমের বিচার করার জন্য আপনার দক্ষ এবং নিবেদিতপ্রাণ লোকজনের দরকার পড়বে। এমন লোক থাকতে হবে যারা সকল প্রকার চাপ এবং ভীতির উর্ধে উঠে প্রকৃত তথ্য বের করে আনবে এবং মানুষের সামনে প্রকাশ করবে।

কিন্তু এমন লোক বের করাটা সহজ হবে না।  আমি জানি না কমিশনে এমন লোক আছে কিনা। কিন্তু যখন অপরাধীরা সশস্ত্র বাহিনীর লোক এবং আপনি এখনো জানেন না এইসব বাহিনী কিভাবে পুরো বিষয়টা দেখছে, তখন আসল তথ্য বের করলে হলে অনেক সাহসী লোক লাগবে। বিশেষত বাংলাদেশে সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে যাওয়াটা ভয়ানক সাহসের বিষয়। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী এখনও তাদের কিছু কর্মকর্তা এবং কমর্চারীর এইসব অপরাধ নিয়ে খোলাখুলি কথা বলার জন্য প্রস্তুত নয়।           

তার বড় উদহারণ এই ব্যাপারে সরকারের প্রথম পদক্ষেপ । সরকার প্রথমে সীমিত কার্যক্ষেত্র ঠিক করে  কমিশন গঠন করে।   পরে তার ব্যাপ্তি বাড়ানো হয়েছে। এর বাহিরে তারা জাতিসংঘ এর সাহায্য চেয়েছে। কিন্তু এত বড় একটি বিষয়ে সরকার কি শুধু এই করে পার পেতে পারে? মনে রাখবেন গুম রাষ্ট্রীয় অপরাধগুলার মধ্যে অন্যতম এবং এর ফলে পুরো সমাজে একটি ভীতিকর এবং অপশাসনের অবস্থা তৈরী হয় এবং ভিন্ন মত প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। সরকারকে দেখে মনে হচ্ছে তারা গুম নিয়ে তাদের দায় যেনতেন ভাবে সারতে চাচ্ছেন এবং এর শেষ দেখতে চাচ্ছেন না। 

এরপর আমরা আরো দুইটি উদাহরণ দেখলাম। কিছুদিন আগে সেনাবাহিনী ‘মায়ের ডাক’র সমন্বয়ক সানজিদার ভাই সাইফুলকে তুলে নেয় । পরবর্তীতে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সাইফুলের বিরুদ্ধে একাধিক চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে । তাই তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হয়েছিল। আইএসপিআর কখনই খুব দক্ষ মুখপাত্র ছিলো না এবং গত সরকারের পতন থেকে তারা কিছু শেখেনি। সাইফুলের বিরুদ্ধে একাধিক চাঁদাবাজির অভিযোগ যদি থাকে তবে পুলিশ তার বাসায় গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারতো। অথবা কোন মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করতে পারতো। কিন্তু এইসব না করে তাকে তুলে নেয়া হলো। 

এরপর আমরা দেখলাম ‘আয়নাঘরে’ সাজ বদল, নষ্ট গুমের আলামত । সমকালের খবর:

একাধিক সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, গুমের সঙ্গে অতীতে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা স্বীকার না করলেও, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভাবমূর্তি রক্ষায় গোপন বন্দিশালাগুলো রাখতে চায় না বাহিনীগুলো। কমিশনকেও এ কথা জানানো হয়েছে। শেখ হাসিনার আমলে ডিজিএফআইয়ের যে বন্দিশালা ছিল তা শুধু বন্ধ নয়, অপসারণ করতে চায়। ভেতরের কুঠুরিগুলো ভেঙে একতলা ভবনটির অভ্যন্তরে পরিবর্তন আনতে কাজ চলছে। এ জন্য নতুন ইট আনা হয়েছে বলে সমকাল জানতে পেরেছে।

তারমানে বাহিনীগুলো আলামত নষ্ট করতে চায়। এবং দেখে মনে হচ্ছে তাতে কমিশনের ও সম্মতি আছে। গুমের বিচার থেকে তাদের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি বাহিনীগুলার কাছে বড় হইলো।  আফসোস যদি বাহিনীগুলো বুঝতে পারতো যে আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির বর্তমান অবস্থা এবং এর উন্নতি এইসব অস্বীকার করে করা যাবে না।    

মায়ের ডাক গত মাফিয়া সরকারের আমলে কাওকে ভয় পায়নি। এখন যদি সেনাবাহিনী মনে করে যে তারা বর্তমান সরকার বা সেনাবাহিনীকে ভয় পাবে তবে তারা ভুল করছে। মায়ের ডাক তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবে এবং কিছুদিন পরপর এইটা নিয়ে তারা নাড়াচাড়া করবে। ফলে এইটা অনেকদিন আমাদের বাহিনীগুলার জন্য একটি অস্বত্তিকর বিষয় হিসেবে থাকবে। তাছাড়া এতবড় ঘটনা কেও বিচার ছাড়া আপনি ‘গুম’ করে লুকিয়ে রাখতে পারবেন না।  এবং এতে এইসব বাহিনীর ভাবমূর্তি খুব উন্নতি হবে না।     

বাংলাদেশ এখন ও এমন পর্যায়ে পৌঁছেনি যেখানে সরকার আমাদের বাহিনীগুলার বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারে। এইটা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ব্যর্থতা এবং একটা রাষ্ট্রীয় এবং পেশাদার প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাহিনীগুলার ব্যর্থতা। এবং এইসব বাহিনীগুলার অন্যায় নিয়ে কথা বলা একটি বিপদজনক কাজ। তাই বাহিনীগুলা যখন চাচ্ছে না তখন বাংলাদেশ গুম এর বিচার ও করতে পারবে না। 

দুঃখ হয় মায়ের ডাকের সদস্যের জন্য।  তারা ভয়ানক এক অবিচারের শিকার হয়েছেন। গত সরকারের আমলে তাদের জীবন ছিল দুর্বিষহ। এখনো তাদের বিচারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।